দুলাল হোসেন:
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মরণ কামড় দিতেই তা মোকাফবলায় হাঁপিয়ে উঠেছিল স্বাস্থ্য খাত। হাসপাতালে শয্যা সংকট, আইসিইউ সংকট, যন্ত্রপাতির অভাব, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে চিকিৎসকের অনুপস্থিতি, চিকিৎসকের সংক্রমণ ভয় ও অবহেলা, নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহসহ নানা দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে আসে। করোনাকালে রোগীদের চিকিৎসা প্রদানে হিমশিম খেয়েছে স্বাস্থ্য খাত। করোনার চিকিৎসা দিতে গিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার আসল চিত্র। যা অত্যন্ত নাজুক ও অন্তঃসারশূন্য। করোনার আক্রমণ রুখে দিতে শতভাগ প্রস্তুত সরকার এমন বক্তব্য দিলেও করোনার বিরুদ্ধে সেবা দিতে গিয়েই ভেঙে পড়েছে গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থা। করোনায় প্রকাশ পেয়েছে দেশের স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর চিত্র।
জানা গেছে, সরকারি, বেসরকারি, ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে হাসপাতাল আছে প্রায় ৬ হাজার। কিন্তু এসব হাসপাতালে নেই করোনা চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট। ব্যবস্থা নেই ভেন্টিলেটর ও সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সরবরাহের। অভাব রয়েছে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর। তার পরও যারা
হাসপাতালগুলোতে কাজ করছেন তাদের সুরক্ষায় নেই পর্যাপ্ত পিপিই। প্রাথমিক পর্যায়ে হাসপাতালে সরবরাহকৃত এন-৯৫ মাস্কগুলো ছিল নকল। ফলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে বেড়ে যায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। এসব নিয়ে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও তাদের পরিবারে বিরাজ করে চরম আতঙ্ক। করোনা পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগার, টেস্ট কিট ও লোকবলের সংকট। করোনা চিকিৎসা কোন কোন হাসপাতালে হবে তা নিয়ে চলছে তেলেসমাতি কারবার। এ ছাড়া করোনায় আক্রান্ত নন এমন সাধারণ রোগীরাও হয়েছেন ভোগান্তির শিকার। আর যেসব হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা চলেছে সেখানেও সমস্যার অন্ত নেই। সব মিলিয়ে দেশে স্বাস্থ্য খাতের যে ভঙ্গুর অবস্থা তা বেরিয়ে এসেছে করোনাকালে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহানে করোনা ভাইরাসের সন্ধান পায়। এর পর এটি বিশে^র বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বাংলাদেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানানো হয় স্বাস্থ্য খাত থেকে। দেশে করোনার ভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত চলতি বছরের ৮ মার্চ। করোনা ভাইরাসের শনাক্ত ও চিকিৎসায় হাত দিয়ে সবকিছু গুলিয়ে ফেলে সরকার। সংক্রমণ বাড়তে থাকলে চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত বিরাট জনগোষ্ঠী। করোনা রোগীদের সামাল দিতে গিয়ে সর্বত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার করুণ অবস্থা। কেন এই বেহাল স্বাস্থ্য খাত তা নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার আশার বাণী শোনালেও দেশের মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। অনিরাপদ ও অরক্ষিত চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন উৎকণ্ঠিত। চিকিৎসার প্রয়োজনে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটছে মানুষ।
করোনার নমুনা পরীক্ষা হয় একটিমাত্র ল্যাবে : দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় চলতি বছরের ৮ মার্চ। প্রথম দিকে করোনা সংক্রমণ কম হলেও দিনে দিনে এটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তখন দেশের একটি মাত্র ল্যাবে আইইডিসিআরে পরীক্ষা সীমাবদ্ধ থাকায় করোনা পরীক্ষা করতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হয় মানুষ। পরে দেশের জনস্বাস্থ্যবিদদের ব্যাপক সমালোনচনার মুখে সরকার মার্চ মাসের শেষ দিকে করোনার পরীক্ষাকেন্দ্র বাড়াতে থাকে। বর্তমানে দেশের ১৬৩টি কেন্দ্রে পরীক্ষা চলছে।
হাসপাতাল ও শয্যা সংখ্যার সংকট : করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুতে ঢাকার মাত্র তিনটি হাসপাতালে করোনার চিকিৎসাসেবা দেওয়া হতো। এসব হাসপাতাল রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেত। রোগীর সেবা নিশ্চিত করতে সরকার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগ-জেলা শহরে করোনার চিকিৎসায় হাসপাতাল প্রস্তুত করে। তবে এসব হাসপাতাল পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) শয্যা ও ভেন্টিলেটর ছিল না। ফলে মুমূর্ষু রোগীরা ভোগান্তির শিকার হয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে করোনা রোগী ও সাধারণ রোগীদের চিকিৎসাসেবা যন্ত্রপাতি, চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট ছিল।
নিম্নমানের মাস্কসহ পিপিই সরবরাহ : দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতে পারসোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই) সংকট চরম আকার ধারণ করে। পরে সিএমএসডি থেকে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নিম্নমানের ও নকল মাস্কসহ পিপিই সরবরাহ করা হয়। পর্যাপ্তসংখ্যক পিপিই না থাকায় অনেক চিকিৎসক হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানান। বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞদের প্রাইভেট চেম্বারে রোগীদের ভোগান্তির সীমা ছিল না।
চিকিৎসকদের সংক্রমণ ভয় ও অবহেলা : করোনা প্রাদুর্ভাবের সময় সংক্রমণের ভয়ে অনেক চিকিৎসক হাসপাতালে গেলেও রোগীদের কাছাকাছি যেতেন না। এ কারণে করোনা রোগীরা হাসপাতালে গিয়ে চরম আতঙ্কে দিন কাটাতেন। এ ছাড়া সংক্রমণ ভয়ে বিশেষজ্ঞরা তাদের প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ রাখেন। করোনা সংক্রমণে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিয়ে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করে।
করোনার নমুনা পরীক্ষায় ভুয়া রিপোর্ট : করোনা ভাইরাসের মতো মহামারীর সময়েও মানুষ অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে পিছপা হয়নি। করোনার নমুনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট তৈরির অভিযোগে জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আরিফুল হক চৌধুরী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা চৌধুরীসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
রিজেন্ট হাসপাতাল কেলেঙ্কারি : অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে লাইসেন্স না থাকার পরও করোনার নমুনা পরীক্ষা ও করোনা রোগীর চিকিৎসাসেবা দায়িত্ব দেওয়া হয় রিজেন্ট হাসপাতালকে। প্রতিষ্ঠানটি করোনার নমুনা পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট প্রদান করে। এ ছাড়া সরকারের কাছ থেকে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় নেওয়ার পরও রোগীর কাছ থেকে বিল নিয়েছে। ভুয়া রিপোর্ট প্রদান ও সরকারের সঙ্গে চুক্তির শর্ত ভঙ্গের অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দেয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমকে ১ নম্বর আসামি করে মামলা করে। সেই মামলায় ৯ দিন পলাতক থাকার পর সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্ত এলাকা থেকে সাহেদকে গ্রেপ্তার করে র্যাবের একটি দল। তাকে ৭ দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠায় আদালত।
Leave a Reply